Inhouse product
রবীন্দ্রোত্তর যুগে সর্বপ্রথম কাজি নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রময় বাংলা সাহিত্যের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে স্বতন্ত্র কাব্যধারা নির্মাণ করেন। রবীদ্র সাহিত্যের বিরোধিতা করাটাই নজরুল সাহিত্যের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। কারণ বিশ শতকের প্রথম দুই দশক ছিল রবীন্দ্রময়। সর্বপ্রথম কাজি নজরুল ইসলামই রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন। কবি-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধে লিখছেন, “কৈশোরকালে আমিও জেনেছি রবীন্দ্রনাথের সম্মোহন, যা থেকে বেরোবার ইচ্ছেটাকেও অন্যায় মনে হতো — যেন রাজদ্রোহের শামিল; আর সত্যেন্দ্রনাথের তন্দ্রাভরা নেশা, তার বেলোয়ারি আওয়াজের জাদু — তাও আমি জেনেছি। আর এই নিয়েই বছরের পর বছর কেটে গেল বাংলা কবিতার; অন্য কিছু চাইলো না কেউ, অন্য কিছু সম্ভব বলেও ভাবতে পারলো না। যতদিন না ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিশেন উড়িয়ে হৈ-হৈ করে নজরুল ইসলাম এসে পৌঁছলেন। সেই প্রথম রবীন্দ্রনাথের মায়াজাল ভাঙলো। …একথা সত্য যে রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।” (‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’, বুদ্ধদেব বসু)
বুদ্ধদেব বসুর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় রবীন্দ্র যুগে কোনো বাঙালি কবিই মৌলিক কাব্যচর্চা করার সাহস পেতেন না। কোনো না কোনো ভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়তেন। নজরুলই সর্বপ্রথম সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে মৌলিকতার স্বাদ বাঙালি সাহিত্যপ্রেমিদের আস্বাদন করান। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল নজরুলের কবিতার দ্বারা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও প্রভাবিত হয়ে পড়েন। নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করলে তখন রবীন্দ্রনাথ নজরুলীয় শৈলীতে কবিতা লিখে আশীর্বাদ জানালেন। তিনি লিখলেন,
অমঙ্গলের মঙ্গল ঘট
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা,
রাতের ভালে হোক্ না লেখা’
জাগিয়ে দেরে চমক্ মেরে’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন।
২৪ শ্রাবণ ২৩২৯ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই কবিতা পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নজরুলের কাব্যশৈলীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
এবার আসা যাক জীবনানন্দের প্রসঙ্গে। তিনিও বাংলা সাহিত্যে নতুন কাব্যধারার নির্মাণ করেন। যা রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদিও জীবনানন্দের প্রাথমিক পর্যায়ের কবিতাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও অন্যান্য অনেক বাঙালি কবিদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়ে রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ (১৯২৭)-এর অনেক কবিতায় নজরুলকে অনুকরণ করেছিলেন।
জীবনানন্দ ‘ঝরা পালকের’ যুগ থেকে রবীন্দ্রপ্রভাব এড়াবার জন্য সচেতনভাবে নজরুলকে অনুকরণ শুরু করেন। তবে তিনি রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য আপ্রাণ সচেষ্ট ছিলেন। তিনি নজরুলের সাহিত্য থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন কীভাবে রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। কারণ তিনি প্রথম থেকেই এটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ করলে বাংলা কাব্যের মুক্তি নেই। এই মুক্ত হতে গিয়ে তিনি নজরুলের সৃষ্টিজগতে অনুপ্রবেশ করেন সচেতনভাবে। তাঁর কাব্যজগত রবীন্দ্রময় থেকে হয়ে ওঠে নজরুলময়। তবে জীবনানন্দ নিজেকে নজরুলীয় প্রভাব থেকেও মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন কারণ তিনি বুঝেছিলেন দেশিয় কবিদের অনুকরণ করলে বাংলা সাহিত্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে না। বাংলা পাঠক কবিতার নতুন কোনো ব্যঞ্জনাও পাবে না। সেজন্য তিনি নিজেকে নজরুলীয় সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত করার জন্য বিদেশি কবিদের অনুকরণ শুরু করেন। নিজস্ব কাব্য প্রতিভা ও পাশ্চাত্যের কবিদের অনুকরণে সৃষ্টি করেন এক স্বতন্ত্র কবিতার সাম্রাজ্য। যে সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ।
আরও একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো কাজি নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশ উভয়েরই জন্ম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু কবি হিসাবে নজরুল ইসলাম জীবনানন্দ দাশের এক দশক পূর্বে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকা করে নেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হওয়ার আগেই নজরুল তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টি বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়ে গেছেন, অর্থাৎ যেসব সাহিত্যের জন্য নজরুল বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি হয় তা ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হওয়ার বহু আগেই তিনি রচনা করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয় দুইজনে একই বয়সী হওয়া সত্ত্বেও নজরুল হয়ে যান জীবনানন্দের পূর্বসূরী আর জীবনানন্দ নজরুলের উত্তরসূরী।
১৯১৯ সালে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলেন এই দুই সমবয়সী কবি। নজরুল সুদূর করাচি থেকে লেখা পাঠিয়েছিলেন কলকাতার ‘সওগাত’ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘মুক্তি’। আর জীবনানন্দের কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকায়। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার নাম ‘বর্ষ আবাহন’। ‘সওগাত’ ছিল অনগ্রসর মুসলমান সমাজের পত্রিকা আর ব্রহ্মবাদী ছিল তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র—জীবনানন্দের পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। কিন্তু শেষপর্যন্ত নজরুল ও জীবনানন্দ মুসলমান বা ব্রাহ্মসমাজে আবদ্ধ হয়ে থাকেননি—বৃহত্তর বাঙালির হৃদয়ে চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছেন। দু’জনেই ছিলেন সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে।
স্বভাবতই এই গ্রন্থটি ইতিহাসপ্রেমিক চিন্তাশীল পাঠক-পাঠিকার প্রাণ স্পর্শ করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
Login Or Registerto submit your questions to seller
No none asked to seller yet